আসাদুজ্জামান তপন : রাজধানীর কারওয়ানবাজারে অফিস শেষে রাত পৌনে ১০টায় বের হন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা। তখন মুষলধারে বৃষ্টি ঝরছিল। মোহাম্মদপুরের শেখেরটেকের বাসায় পৌঁছাতে তাঁর সময় লেগেছে প্রায় তিন ঘণ্টা। শুধু তিনিই নন, টানা প্রায় ছয় ঘণ্টার ভারী বৃষ্টিতে রাজধানীর প্রধান সড়কসহ অলিগলিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় যান চলাচল ব্যাহত হয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন ঘরমুখো মানুষ।
ঢাকায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত তুমুল বৃষ্টি হয়। সঙ্গে চলে বজ্রপাত ও দমকা হাওয়া। মিরপুরে কমার্স কলেজ–সংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তির বিপরীত পাশে জলাবদ্ধ সড়কে বিদ্যুতের তাঁর ছিঁড়ে পড়ে। এতে জলমগ্ন সড়কে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন একই পরিবারের চারজন। তাঁদের তিনজনই মারা গেছেন। ওই পরিবারের সাত মাস বয়সী এক শিশু গুরুতর অবস্থায় ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পুলিশের ভাষ্যমতে, এই পরিবারকে বাঁচাতে গিয়ে আরেক তরুণ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন। মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ওসি জানান, নিহতদের মধ্যে তিনজন একই পরিবারের। তারা হলেন- মো. মিজান (৩০), তার স্ত্রী মুক্তা বেগম (২৫) ও মেয়ে লিমা (৭)। এই দম্পতির ছয়মাস বয়সী ছেলে হোসাইনকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ঘটনার সময় পরিবারটিকে বাঁচাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মোহাম্মদ অনিক (২০) নামে আরেক তরুণের মৃত্যু হয়েছে। তারা সবাই ঝিলপাড় বস্তির বাসিন্দা।
এ ছাড়া বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে ঢাকায় বজ্রপাতসহ প্রবল বৃষ্টি হয়। এতে রাজধানীর প্রধান সড়কসহ অলিগলি পানিতে তলিয়ে যায়। বেশির ভাগ জায়গায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে যান চলাচল ব্যাহত হয়।
ভারী বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার কারণে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে কার্যত যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বৃষ্টি শেষে যান চলাচল শুরু হলে সড়কে দেখা দেয় গাড়ির চাপ। এতে মধ্যরাতেও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা দেয় তীব্র যানজট। বৃষ্টির কারণে অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে বলেও জানা গেছে।
কারওয়ানবাজারের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওই কর্মকর্তা এনবি নিউজকে বলেন, অফিসের সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে এক সহকর্মীর সঙ্গে বাসার উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। পথে বিজয় সরণিতে পানি ঢুকে অটোরিকশাটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন অটোরিকশা থেকে নেমে রিকশায় করে কলেজ গেট পর্যন্ত পৌঁছান তিনি। সেখানে তাঁর স্বামী মোটরসাইকেলে এসে তাঁকে শেখেরটেকের বাসায় নিয়ে যান। তখন ঘড়িতে বাজে রাত সাড়ে ১২টা। সঙ্গে থাকা সহকর্মী তখনো কল্যাণপুরের বাসায় পৌঁছাতে পারেননি।
রাস্তায় জমে থাকা পানির কারণে বাসায় ফিরতে গিয়ে একই অভিজ্ঞতার মুখে পড়েন সাংবাদিক তুহিন সাইফুল্লাহ। রাত সাড়ে ১২টার দিকে তিনি বলেন, কারওয়ানবাজারে অফিস থেকে বের হয়ে প্রায় ৪০ মিনিট ফার্মগেটে আটকে রয়েছেন। জলজটের কারণে যানবাহন থেমে থেমে চলছে। তখনো হালকা বৃষ্টি ঝরছিল। তিনিও যাবেন মোহাম্মদপুরে।
মধ্যরাতে ভোগান্তির কথা তুলে ধরে আরেক সাংবাদিক ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মহাখালী থেকে শেওড়াপাড়া আসতে প্রায় ৪ ঘণ্টা! এখন রাত ১টা। বাসায় যাব কখন?’
মধ্যরাতে যানজটের এ চিত্র পুরো নগরীতেই। এর আগে বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতায় রাত ১১টার দিকে রাজধানীর বেগম রোকেয়া সরণিতে কয়েক শ গাড়ি আটকা পড়ে। এর আধা ঘণ্টা আগেই তলিয়ে যায় গ্রিন রোড এলাকা। রাত সোয়া ১০টার দিকে ওই সড়কে বহু গাড়ি আটকে থাকতে দেখা যায়। মিরপুর, ধানমন্ডি, নীলক্ষেত, কাঁটাবন, হাতিরপুল এলাকার সড়কেও একই চিত্র।
জলজট ও যানজটের মধ্যে বাড়তি রিকশা ভাড়া নিয়ে অভিযোগ করতে দেখা গেছে অনেককে। ফেসবুকে একজন লিখেছেন, ‘পান্থপথ সিগন্যাল থেকে সেন্ট্রাল রোডে রিকশা ভাড়া চাইল ২০০ টাকা। একজন না অনেকজন রিকশাওয়ালা। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমাদের মাঝে জিম্মি করার প্রবণতা বেশি। সব পেশাজীবীদের মাঝেই।’
এদিকে রাত নয়টার দিকে ধানমন্ডি ১৪ নম্বরের ২২ নম্বর বাড়ির সামনে একটি কড়ই গাছ ভেঙে সড়কের ওপর পড়ে। এতে কেউ হতাহত হননি। তবে রাস্তায় তীব্র যানজট লেগে যায়। ফায়ার সার্ভিস বলছে, গাছটি এতই বড় যে তা তাদের পক্ষে সরানো সম্ভব হয়নি। রাতে ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে বলা হয়, বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়ছে, আবার আগুন লেগেছে—এমন খবর দিয়ে সাহায্য চাওয়া হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান রাত ১২টার দিকে এনবি নিউজকে বলেন, পানি অপসারণের ব্যবস্থায় সমস্যার কারণে অতিবৃষ্টিতে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থান পানিতে ডুবে গেছে। এই অবস্থায় সড়কে ধীরগতিতে যানবাহন চলছে। বেশি পানি জমে যাওয়ায় কোনো কোনো স্থানে গাড়ি চলতে পারছে না। বৃষ্টিও চলছে, এ কারণে সড়ক থেকে পানি কমছে না। এসব কারণে রাস্তায় রাস্তায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। যানবাহনে আটকে পড়ে লোকজন। তবুও এসব স্থানে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন।
ঢাকায় সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ১১৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে। শুক্রবারও বৃষ্টি হতে পারে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর ঢাকা ছাড়াও রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগে বৃষ্টি হয়েছে বলে আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে।
আগামীকালের পূর্বাভাসে অধিদপ্তর জানিয়েছে, রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের বেশির ভাগ জায়গায় এবং ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হতে পারে। এ সময় বজ্রপাতও হতে পারে। সেই সঙ্গে রংপুর, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বৃষ্টি হতে পারে।