সাধারণভাবে এলএসডি হয় বর্ণ ও গন্ধহীন। ব্লটার কাগজ, চিনির কিউব, বা জেলটিনের আকারে এ মাদক বিক্রি করা হয়।
গবেষণায় এলএসডির আসক্তি তৈরির কোনো প্রমাণ মেলেনি। তবে এ মাদক মস্তিষ্কের ক্রিয়ার ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলে, তাতে উদ্বেগ, প্যারানয়া কিংবা বিভ্রম ঘটার মত পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে।
মজিবুর রহমান পাটোয়ারি বলেন, “এলএসডির প্রভাব মারাত্মক। এটা গ্রহণের পর রক্তচাপ বেড়ে যায়, দেহের তাপমাত্রাও বাড়ে, দৃষ্টি বিভ্রম বা হেলুসিনেশন হতে পারে। তখন নিজের ওপর মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।”
১৯৩৮ সালে এরগট নামের এক ধরনের ছত্রাক থেকে ওষুধ বানানোর গবেষণা করতে গিয়ে সুইস রসায়নবিদ আলবার্ট হফম্যান তৈরি করে ফেলেন এলএসডি, যা নিয়ে পরে নানা রকম গবেষণা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে এলএসডিসহ সব ধরনের সাইকাডেলিক ড্রাগ নিষিদ্ধ। জাতিসংঘও ১৯৭১ সালে চিকিৎসার ক্ষেত্রে এলএসডি ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।
এলএসডির ভয়াবহতা বিবেচনায় ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনেও এটাকে নিষিদ্ধ মাদকের তালিকায় রাখা হয়।
এই প্রথম নয়
নিষিদ্ধ ঘোষণার প্রায় ২৯ বছর পর দেশে প্রথমবারের মত এলএসডির একটি চালান জব্দ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।
২০১৯ সালের ১৫ জুলাই রাজধানীর মহাখালী ডিওএইচএসের একটি বাড়ি থেকে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এলএসডির ২৫টি স্ট্রিপ (ব্লট) এবং ৫ মিলিলিটার তরল এলএসডি উদ্ধার করেন। ওই ঘটনায় কাফরুল থানায় একটি মামলা করেন অধিদপ্তরের তখনকার সুপার ফজলুল হক খান।
সেই মামলার দুই আসামি ইয়াসের রিদওয়ান আনান (২১) এবং সৈয়দ আহনাফ আতিফ মাহমুদ (২১) এখন জামিনে রয়েছেন। অভিযোগপত্র দেওয়ার পর মামলাটি এখন বিচারাধীন।
মামলার বাদী ফজলুর হক এনবি নিউজকে বলেন, অনলাইনে মাদক বেচাকেনার তথ্য পেয়ে ক্রেতা সেজে তারা ওই অভিযানটি চালিয়েছিলেন।
“ইয়াসের রিদওয়ান কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। সেখান থেকে তিনি তেলের বোতলে ভরে তরল এলএসডি এবং ডাক টিকেটের মত দেখতে এলএসডি স্ট্রিপ নিয়ে আসেন। তবে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বলেছিলেন, কানাডায় পড়তে যাওয়ার আগে থেকেই তিনি মাদকাসক্ত ছিলেন। দেশেও তিনি এলএসডি সেবন করেছিলেন।”
অনলাইনে বিক্রি
ওই অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা শাখার তৎকালীন সহকারী পরিচালক মেহেদি হাসান। বর্তমানে তিনি বগুড়ায় অধিদপ্তরের উপপরিচালক।
এনবি নিউজকে তিনি বলেন, এক ‘সোর্সের মাধ্যমে’ তারা সে সময় অনলাইনে এলএসডি বেচাকেনার খবর পান। প্রথম দফায় তারা যোগাযোগ করে দুই হাজার টাকা করে দুটো ব্লট কেনেন। দ্বিতীয় দফায় মহাখালী গিয়ে হাতেনাতে ধরে ফেলেন।
মেহেদি হাসান জানান, দেশেই ব্লটিং পেপার কিনে তাতে পরিমাণমত তরল এলএসডি মিশিয়ে ‘ব্লট’ তৈরি করতে পারতেন ইয়াসের রিদওয়ান।
“তার মোবাইল ফোন পরীক্ষা করে এলএসডির ডোজ তৈরির কলাকৌশলের টেক্সট ও ভিডিও পাওয়া গিয়েছিল। তিনি ওই সব দেখেই ব্লট তৈরি শেখেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানান।”
এবার নতুন করে যখন এলএসডির বিষয়টি আলোচনায় আসছে, তখনও অনলাইনে কেনাবেচার বিষয়টি সামনে আসছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে গোয়েন্দারা এলএসডির যোগসূত্র পেয়েছেন বলে গত বৃহস্পতিবার পুলিশের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
সেখানে বলা হয়, গত বুধবার ঢাকার লালমাটিয়া ও ধানমণ্ডি থেকে সাদমান সাকিব রুপল (২৫), আসহাব ওয়াদুদ তূর্য (২২) ও আদিব আশরাফ (২৩) নামে হাফিজুরের তিন বন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের কাছ থেকে ২০০ ব্লট এলএসডি পাওয়া গেছে।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সাদমান বলেছেন, তিনি টেলিগ্রাম অ্যাপে যোগাযোগ করে টিম নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে নেদারল্যান্ডস থেকে এলএসডি আনিয়েছেন। সেজন্য প্রতি ব্লটে খরচ হয়েছে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা। কুরিয়ার সার্ভিস এর মাধ্যমে ওই মাদক দেশে এসেছে।
সেগুলো বিক্রির জন্য তাদের দুটি ফেইসবুক গ্রুপ রয়েছে। এর একটির নাম ‘আপনার আব্বা’। আরেকটির নাম ‘বেটার ব্রাউনি অ্যান্ড বিয়ন্ড’। এসব গ্রুপ থেকে তারা গাজার নির্যাস মিশ্রিত কেকও (ব্রাউনি) বিক্রি করেন।
রয়েছে আরো চক্র
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মেহেদি হাসান বলেন, ২০১৯ সালের ঘটনাটির তদন্ত করতে গিয়ে গুলশান-বনানীতে আরো কয়েকটি চক্রের এলএসডি বিক্রির তথ্য তারা জানতে পেরেছিলেন। তবে ইয়াসের রিদওয়ান গ্রেপ্তার হওয়ার পর তারা গা ঢাকা দেয়।
“সেসব চক্রে নারীরাও যুক্ত ছিলেন। গ্রেপ্তার হওয়া ইয়াসেরদের কাছ থেকে তখন জানা যায়, তাদের জন্য আরেকটি চালান নিয়ে আসছেন কানাডায় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আরেক বাংলাদেশি ছাত্র। ওই ছাত্রের ভ্রমণ তারিখ, টিকিট সংক্রান্ত তথ্যও যোগাড় করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি আসেননি।”
মেহেদি হাসান বলেন, “তখন গ্রেপ্তার দুজন জিজ্ঞাসাবাদে বলেছিলেন, তারা অনেকটা পরীক্ষামূলকভাবে এলএসডির ওই চালানটি দেশে আনেন। দেশের বিভিন্ন পার্টিতে উচ্চবিত্ত তরুণেরা এলএসডির ডোজ নিতেন বলে তারা জানান। এইসব তরুণদের অনেকেই দেশের বাইরে লেখা-পড়া করেন।”
এলএসডি দেশে বাজার পেলে কানাডা থেকে ‘ম্যাজিক মাশরুম’ আনার পরিকল্পনাও ইয়াসেররা করেছিলেন বলে এনবি নিউজকে জানান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা। ম্যাজিক মাশরুমও আরেকটি শক্তিশালী সাইকাডেলিক ড্রাগ।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক দুলাল কৃষ্ণ সাহা এনবি নিউজকে বলেন, ২০১৯ সালে উদ্ধার করা মাদকের রাসায়নিক পরীক্ষা করে সেগুলো এলএসডি বলে নিশ্চিত হয়েছিলেন তারা।
আর অতিরিক্ত পরিচালক মজিবুর রহমান পাটোয়ারি বলেন, “এখন পর্যন্ত ধারণা করা যায়, দেশের উচ্চবিত্ত শ্রেণির কিছু তরুণের মধ্যে সীমিত পরিসরে এলএসডির ব্যবহার রয়েছে। দেশে ইয়াবার অপব্যবহারও শুরু হয়েছিল উচ্চবিত্ত কিছু তরুণের হাত ধরেই।”